ওয়াকফ – ভারতকে দারুল ইসলাম বানানোর অন্যতম হাতিয়ার

১২০৪ সাল থেকে বঙ্গভূমির উপরে ইসলামের আক্রমণ শুরু হয়। বখতিয়ার খিলজি নবদ্বীপ দখল করেন। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করে তিনি কোচদের হাতে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হন এবং ১২০৬ সালে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সদ্য অধিকৃত নদীয়ায় বেশ কয়েকটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ তৈরি করেন। যে কোনও মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মুসলিম শাসকরা অধিকৃত ভূমিতে গুরুত্ব সহকারে মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। শক, হূণ, কুষাণ ইত্যাদি বহিরাগত হানাদারদের আক্রমণের সাথে ইসলামী আক্রমণের এটা অন্যতম মূলগত পার্থক্য। মুসলমানদের আক্রমণের পিছনে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের প্রেরণা ছিল না, ছিল ধর্মীয় প্রেরণা। অবশ্য ইসলাম অনুযায়ী সাম্রাজ্য বিস্তার (দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা) এর জন্য বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ (জেহাদ), বিধর্মীদের সম্পদ এবং নারী লুন্ঠন (গনিমতের মাল) এগুলিও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাই আমরা সনাতন ধর্মকে যে চোখে দেখি, ইসলামকে সেই চোখে দেখলে হবে না। আমাদের সনাতন ধর্ম‌ও অবশ্যই রাজনীতি বাদ দিয়ে নয়। রামায়ণ, মহাভারত পড়ুন, রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা উশীনরের উপাখ্যান পড়ুন, জানতে পারবেন সনাতনী দৃষ্টিতে ক্ষাত্রধর্ম কি। ওদের সাথে আমাদের এই পার্থক্য সাংস্কৃতিক উত্তরণের স্তরের পার্থক্য। চাল, ভাত আর পায়েসের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে, এই পার্থক্য হল সেটাই। তাই ধর্মের প্রসঙ্গ উঠলেই মুড়ি-মুড়কি একদর গোছের ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি না আওড়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে।

যাইহোক, মূল আলোচ্য বিষয় ধর্মের নামে জমি দখলের চক্রান্ত। এই জমি দখল আসলে এক প্রকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। তবে এই আগ্রাসন শুধুমাত্র রাজনৈতিক আগ্রাসন নয়। এই আগ্রাসন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও বটে। এই আগ্রাসনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নয়, এর উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী নিজেদের মতবাদের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য মতবাদের ধ্বংস। সেই অর্থে এই আগ্রাসনকে সভ্যতার সংঘাত বা Clash of Civilisation  বলাই যুক্তিযুক্ত। মুসলিম আক্রমণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন যে কোনও এলাকায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা হ‌ওয়ার পরেই সেখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সমাজ ব্যবস্থা, রীতি-নীতি, পরম্পরা, শ্রদ্ধার কেন্দ্রবিন্দু, গৌরবের চিহ্ন – সমস্ত কিছু ধ্বংস করে সেখানে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।  সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মাজার ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গুরুত্ব সহকারে এবং এই উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা জমিকে আল্লাহ-র কাছে উৎসর্গ করা হয়েছে, অর্থাৎ সেই জমির মালিক হয়েছেন আল্লাহ স্বয়ং। আল্লাহর মালিকানাধীন এই ধরণের সম্পত্তিকে আউকাফ বা ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। মুসলিম শাসনাধীন বঙ্গে শাসকদের এবং সাধারণ মুসলিম সমাজের উদ্যোগে এইভাবে অসংখ্য ওয়াকফ সম্পত্তি তৈরি হয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগ‌ই দেশভাগের পরেও ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবেই আছে, অধুনা বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও। জমি দখল বস্তুত এই সার্বিক আগ্রাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

মনে করুন আপনার জমিটা আমি জোর করে দখল করে নিলাম। তারপরে সেই জমি দান করে ওয়াকফ করলাম। যখনই আপনি জমি ফেরতের জন্য আওয়াজ তুললেন, তখনই আরও জোরে আমি চিৎকার শুরু করলাম যে ওয়াকফ সম্পত্তি হল অনাথালয়, শিক্ষাকেন্দ্র ইত্যাদি মহৎ কাজের জন্য উৎসর্গীকৃত জমি। এই চিৎকারে আসল সত্যটা চাপা পড়ে গেল যে আসলে সেই জমিটা জোর করে দখল করাই আমার অপরাধ ছিল। বিদেশী মুসলিম সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত আক্রমণ করে শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল এবং আমাদের জমি দখল করে ওয়াকফ করে গেছে। বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও যদি সেই জমির স্টেটাস পরিবর্তন না হয় তাহলে এই স্বাধীনতার মানে কী!   

দেশে এখন ৬ লক্ষের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে, যার ৪৯% আছে কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশে। দেশে প্রতিরক্ষা, রেল মন্ত্রকের পর তৃতীয় বৃহৎ সম্পত্তি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ২০০ টি। যার মাত্র ২৩ হাজারের মতো সম্পত্তি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের আওতায়। প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার সম্পত্তির কোন হদিস নেই। তবে এখন হদিস না থাকলেও এগুলো যে কোনও দিন আত্মপ্রকাশ করবে তাতে সন্দেহ না থাকাই উচিত। ২০১০ সালে কলকাতা বাদে গোটা রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে যে সার্ভে করা হয় তাতে দেখা গিয়েছে ১৬,৪৩,৩৬০ একর সম্পত্তি রয়েছে গোটা রাজ্যে।

কলকাতায় ব্রিটিশরা টিপু সুলতানের পরিবারকে নির্বাসিত করেছিল টালিগঞ্জে। সেই টালিগঞ্জের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সংলগ্ন সতীশচন্দ্র রায় রোডের ওয়াকফ সম্পত্তির উপরে আজ মার্কেট কমপ্লেস হলেও জমির মালিক তো ওয়াকফ বোর্ডেরই? প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডেই অবস্থিত দাতাবাবার মাজার। দাতাবাবা মাজার লাগোয়া আরপি কলোনির সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি। টালিগঞ্জে গলফ-ক্লাবের জমি ওয়াকফের, ক্লাব আজও তার ভাড়া দেয়। কলকাতার (দক্ষিন) যাদবপুরের মতো জায়গার সুলেখা মার্কেট, গড়ফা, পূর্বাচল কিংবা সন্তোষপুরে ব্যাপক সংখ্যক সম্পত্তি কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তি। রাজভবন (গভর্নর হাউস), মোহামেডান, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ক্লাবের জায়গাও ওয়াকফের। এমনকি আকাশবাণী ভবন (কলকাতা), ফোর্ট উইলিয়ামস (ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর), ময়দান ও সংলগ্ন এলাকা, ইডেন গার্ডেনস ওয়াকফ সম্পত্তি। সবই ওয়াকফ সম্পত্তি, যার জমির পরিমাণ ২৫৫৫ বিঘা। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সরকার ১৯৯ টাকা ভাড়া দিত। তারপর মোতায়ালি (তদারক কারী) মওলানা আবুল বরকত সাহেব ৯৯ বছর বয়সে মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীকে আর ভাড়া দেয় না রাজ্য সরকার। বাংলা বিহার-ওড়িশার নবাব আলীবর্দি খাঁ তার শাসনকালে এই ২৫৫৫ বিঘা জমি ওয়াকফ করে যান।

লক্ষ্য করুন, মুসলিম শাসনের অবসান হয়েছে, ইংরেজ শাসন শেষ হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছে কিন্তু একটা বিশাল পরিমাণ জমির মালিক থেকে গেছেন আল্লাহ। অর্থাৎ এই জমির উপরে মুসলমানদের দখল থেকে গেছে আইনত। মুসলমানরা ইতিমধ্যেই ওয়াকফ সম্পত্তিগুলোর দাবিদার হিসেবে আওয়াজ তোলা শুরু করেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে হিন্দুরা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসেন ও মুসলিমরা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায়।পাকিস্তান হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে দেয় কিন্তু গান্ধী এবং নেহরু মুসলিমদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিন্দুদের স্পর্শ পর্যন্ত করতে দেয় নি, তারা সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে ওয়াকফ বোর্ড কে হস্তান্তর করে। কংগ্রেস নেতা প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইন পাস করেন যার দ্বারা ওয়াকফ বোর্ড কে জমি দখল করার জন্য অপরিসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শোনা যায় ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগেই তৎকালীন কংগ্রেস সরকার এই আইনটি ব্যবহার করে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডকে দিল্লির বুকে ১২৩টি সম্পত্তি দখলে রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল। বর্তমানের বাজারদরের ভিত্তিতে যে সম্পত্তির মূল্য অসীম বলেই দাবি করা হচ্ছে। এমনকী ২১-২২ সালে তামিলনাড়ুর ৬টি গ্রামকে ওয়াকফ বোর্ড তাদের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করে। মজার বিষয় যার মধ্যে একটি দেড় হাজার বছরের পুরনো হিন্দু মন্দিরও আছে।

কিছুদিন আগের ঘটনা। একজন বাংলাদেশী নাগরিক নিজেকে বিখ্যাত পান্ডুয়া মসজিদের মোতোয়ালি হিসেবে দাবি করেন। তিনি পান্ডুয়ায় থেকে মোতোয়ালি হিসেবে কাজ‌ও শুরু করছিলেন। অভিযোগ ওঠায় আদালত তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মালদা জেলার প্রশাসনকে। যদিও তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কিছুদিন আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি ছেলে আমার সাথে দেখা করে। দেশভাগের সময় স্থানীয় এক মুসলমানের সাথে তারা ‘জমি বিনময়’ করে ভারতে চলে আসে। এখানে সেই মুসলমানের জমিতে একটি ছোট মসজিদ ছিল। বাংলাদেশ থেকে আসা পরধর্মে শ্রদ্ধাশীল হিন্দু পরিবারটি সংস্কারবশতঃ সেই মসজিদটাকে ভেঙে ফেলে নি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে চলে যাওয়া সেই মুসলিম পরিবারের কোনও এক আত্মীয় স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে এসে সেই মসজিদ এবং সংলগ্ন জমি ওয়াকফ বলে দাবি করে।

মনে রাখতে হবে যে রাজনৈতিক শাসন ক্ষমতা অস্থায়ী কিন্তু ওয়াকফের মাধ্যমে জমি দখল আইনত স্থায়ী। পৃথিবীর বুকে প্রতিটি ভূমিখন্ড হল ইউনিক। এর কোনও ডুপ্লিকেট হয় না। এক একটা প্লট এভাবে দখল হ‌ওয়া মানে হল স্বাধীন ভারতে আইনত নিজের পায়ের তলার মাটির উপরে হিন্দুর দখল হারানো।

হাদীস ও ইসলামী সংস্কৃতির রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় কাজে চিরস্থায়ীভাবে নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে ওয়াকফ। যিনি দাতা তাকে বলা হয় ওয়াকিফ এবং যিনি ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করেন তাকে বলা হয় মোতোয়ালি। আগেই আমি বলেছি যে মুসলিম শাসনকালে প্রচুর সম্পত্তিকে ওয়াকফ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে যে স্বাধীন ভারতে, বিশেষত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পরে স্বাধীনতার আগে করা ওয়াকফ সম্পত্তির কোনও বৈধতা থাকা কি উচিত? দেশভাগের পরে অনেক মুসলমান ভারতে তাদের জমি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছে। পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে অনেক হিন্দু পরিবার সেই সমস্ত খালি জমিতে বসতি স্থাপন করেছে, ব্যবসা শুরু করেছে। সেই সময়ে কোনও জমি ওয়াকফ ছিলো, এই কথা বলে সেই সময়কার রেকর্ড দেখিয়ে আজকে যদি কেউ সেই জমির অধিকার দাবি করে, সেই দাবি কি অনৈতিক নয়? ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতে একদা বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ-র করে যাওয়া ওয়াকফের কী মূল্য আছে? দেশভাগের ফলে গোটা দেশটার স্ট্যাটাস পরিবর্তন হয়ে গেল অথচ এইভাবে ওয়াকফ করা জমিগুলোর স্ট্যাটাস আজও অপরিবর্তিত থাকবে? সরকার এই জমির ভাড়া দেবে?

এখন দেখা যাক আমাদের দেশের ওয়াকফ আইন কী বলছে। এই আইনে রাজ্য সরকারকে নিজের রাজ্যের জন্য ওয়াকফ বোর্ড গঠন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে (U/S 13/1 of The Wakf Act, 1995)। এই বোর্ডে কোনও হিন্দু স্থান না পেলেও তারকেশ্বরের হিন্দু মন্দিরের কমিটির মাথায় অনায়াসে একজন মুসলিম বসতে পারেন। ওয়াকফ বোর্ড রাজ্যের সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রক। এই আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকার নিযুক্ত একজন সার্ভে কমিশনারের তত্ত্বাবধানে সার্ভের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলোকে চিহ্নিত করতে হয়((U/S 4/1 of The Wakf Act, 1995) । কমিশনার তার সার্ভে রিপোর্ট রাজ্য সরকারকে দিলে রাজ্য সরকার সেটা ওয়াকফ বোর্ডের কাছে পাঠিয়ে দেয় এবং ওয়াকফ বোর্ডকে এই রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির একটা তালিকা তাদের অফিসিয়াল গেজেটে প্রকাশিত করতে হয়। আইন বলছে, যদি এই তালিকা সম্পর্কে কারও কোনও অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে ওই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে এক বছরের মধ্যে ওয়াকফ ট্রাইবুনালের সামনে দাখিল করতে হবে। এই সময়ের পরে আর কোনও আপীল ট্রাইবুনাল গ্রহণ করবে না এবং প্রকাশিত ওয়াকফের তালিকাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি জানেন যে আপনার জমি ওয়াকফের তালিকাভুক্ত কি না? আপনি কি জানেন এই তালিকা কোথায় প্রকাশিত হয়েছে? আপনি কি জানেন যে ওয়াকফ সম্পর্কিত কোনও অভিযোগের বিচার করার এক্তিয়ার কোনও সিভিল কোর্টের নেই?

ওয়াকফ আইন অনুযায়ী যে কোনও সম্পত্তির ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ড যদি মনে করে যে সেটা ওয়াকফ সম্পত্তি, ওয়াকফ বোর্ড নিজেই তার তদন্ত শুরু করতে পারে, শোকজ নোটিস পাঠাতে পারে এমনকি অর্ডার পাশ করতে পারে। ওয়াকফ বোর্ডের এই আদেশ চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে যদি না সেটা ট্রাইবুনাল কর্তৃক পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ওয়াকফ বোর্ডকে এক্ষেত্রে সুয়োমোটো পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তিতে এনক্রোচমেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা নিজের উদ্যোগে বোর্ড সরাসরি জায়গা খালি করার আদেশ দিতে পারে। অর্থাৎ আগামীকাল সকাল বেলাতেই ইডেন গার্ডেন, ফোর্ট উইলিয়াম কিংবা আকাশবাণীকে জায়গা খালি করে দেওয়ার নির্দেশ পাঠানোর আইনসম্মত অধিকার ওয়াকফ বোর্ডের আছে। অর্থাৎ ওয়াকফ বোর্ডই পুলিশ, ওয়াকফ বোর্ডই উকিল, ওয়াকফ বোর্ডই বিচারক বা জজ।

ওয়াকফ বোর্ড তাজমহল কুতুবমিনার লালকেল্লা ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও নিদর্শনকেও নিজেদের বলে দাবি করছে এবং আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (ASI) হাত থেকে তাদের হাতে সমর্পন করার দাবি জানিয়েছে। বম্বের এবং ভারতের সবচাইতে বিলাসবহুল বাড়ি ‘আ্যনটিলা’ যা মুকেশ আম্বানির বাড়ি বলে আমরা সবাই জানি – সে বাড়িটিও ওয়াকফ বোর্ড তাদের বলে দাবি করে নোটিশ পাঠিয়েছে। মুকেশ আম্বানি বলেই সেটির দখল এখনো নিতে পারে নি, কিন্তু ওয়াকফ বোর্ড যদি আদাজল খেয়ে লাগে তাহলে মুকেশ বাবাজীর অন্যত্র বাসাবাড়ি খুঁজতে হবে।

ভাবুন তো, হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা করা কিংবা সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের দেশে কোনও শক্তপোক্ত ব্যবস্থা আছে? কেউ কি ভেবেছে সেকথা? কত দেবোত্তর সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে কেউ কি তার খবর রাখে? দেশভাগের মাধ্যমে আমরা মাটি হারিয়েছি। এখনও আমাদের মাটি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত চলছে বিভিন্নভাবে। ওয়াকফ বিষয়টি একটি ঘুমন্ত দৈত্য। আমরা এবিষয়ে সচেতন না হলে এ মাটির দখল আবার ছাড়তে হবে। তাই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে ভারতের বুকে যত সম্পত্তি ওয়াকফ করা হয়েছে, সেগুলোর ওয়াকফনামা অবৈধ বলে ঘোষণা করাই এই বিপদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বলে আমি মনে করি।

যাইহোক, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার ওয়াকফ আইনে সংশোধন করার উদ্যোগ নিলেও বাদবাকী প্রায় সব রাজনৈতিক দলই মুসলমানদের সামনে নতজানু। ওয়াকফ সম্পত্তি যাতে বেদখল না হয়, তারজন্য সবাই উদ্বিগ্ন। ২০১১ তে ক্ষমতায় আসার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওয়াকফ সম্পত্তি নয়-ছয়ের তদন্তের ভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দিতে চান। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই তিনি মুসলমানদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে ৩২টি ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিশেষ তদন্তের ভার তুলে দিয়েছিলেন সিআইডি-র হাতে। মুসলিম সংগঠন এবং নেতারাও ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে মাঝেমাঝেই সুর চড়াচ্ছেন। তারা দাবী করেছেন যে কলকাতায় যে পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি আছে তার ভাড়াই ৮০০ কোটি টাকা। দাবি উঠেছে ‘ওয়াকফ সম্পত্তিতে আমাদের অধিকার’। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড হুঙ্কার দিয়েছে, ওয়াকফ আইনের উপরে হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। মোদী সরকার ওয়াকফ আইনের ৪০ টি ধারার মধ্যে সংশোধন আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হবে। বিলটি এখন জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে আছে। এই বিলে সরকার ঠিক কি কি সংশোধনের প্রস্তাব এনেছে সেটা একবার দেখা যাক।

ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৪ লোকসভায় পেশ করা হয় ৪ঠা আগস্ট, ২০২৪ তারিখে। এটি ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ এর প্রস্তাবিত সংশোধন। ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ আইনটি বর্তমানে ভারতের সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে।  ওয়াকফ পরিচালনার জন্য প্রতিটি রাজ্যকে একটি ওয়াকফ বোর্ড গঠন করতে হয়। মনে রাখতে হবে যে এই ওয়াকফ বোর্ড কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি আসলে সম্পত্তির ম্যানেজমেন্ট করার জন্য গঠিত প্রতিষ্ঠান।

ওয়াকফ সম্পত্তির গঠন: এই   বিলটিতে বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি, যিনি কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন তিনিই ওয়াকফ ঘোষণা করতে পারেন। এই ব্যক্তিকে অবশ্যই ঘোষিত সম্পত্তির মালিক হতে হবে।

ওয়াকফ হিসাবে চিহ্নিত সরকারি সম্পত্তি:  বিলে বলা হয়েছে যে ওয়াকফ হিসাবে চিহ্নিত যে কোনও সরকারি সম্পত্তি এই সংশোধিত আইন অনুযায়ী আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। এই সম্পত্তির ওয়াকফ স্টেটাস বাতিল হয়ে যাবে।   এই ধরণের বিতর্কিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এলাকার কালেক্টর সেই সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণ করবেন এবং রাজ্য সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন। সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হলে তিনি সেই সম্পত্তির রেভিনিউ রেকর্ড আপডেট করবেন।

কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা তা নির্ধারণের ক্ষমতা: বর্তমান আইনটি ওয়াকফ বোর্ডকে কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা তা অনুসন্ধান ও নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেয়, কিন্তু কেন্দ্র সরকার প্রস্তাবিত সংশোধনী বিল ওয়াকফ বোর্ডের এই ক্ষমতা খারিজ করেছে। 

ওয়াকফের জরিপ: বর্তমান আইনটি ওয়াকফ জরিপের জন্য একজন সার্ভে কমিশনার এবং অতিরিক্ত কমিশনার নিয়োগের বিধান দিয়েছে। পক্ষান্তরে প্রস্তাবিত   বিলটি এর পরিবর্তে কালেক্টরদের ওয়াকফ সম্পত্তি জরিপ করার ক্ষমতা দিয়েছে।  এই বিল আইনে পরিণত হওয়ার পরে ওয়াকফ সম্পত্তি জরিপের কাজ যতটা বাকি থেকে যাবে, সেই কাজ রাজ্যের রাজস্ব আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল: বর্তমান আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এবং ওয়াকফ বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে।   ওয়াকফের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পদাধিকারবলে ওয়াকফ কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন। বর্তমান আইন অনুযায়ী ওয়াকফ কাউন্সিলের সকল সদস্যকে মুসলিম হতেই হবে এবং কাউন্সিলে কমপক্ষে দুজন মহিলা সদস্য থাকতে হবে। প্রস্তাবিত  বিলে এর পরিবর্তে ওয়াকফ কাউন্সিলে দুইজন অমুসলিম সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক এবং কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে দুজন মহিলা থাকতে হবে।

ওয়াকফ বোর্ড:   বিলটি বর্তমান আইন অনুযায়ী মুসলমান সাংসদ, বিধায়ক, বিধান পরিষদের সদস্য, বার কাউন্সিল মেম্বারদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড গঠনের পরিবর্তে রাজ্য সরকারকে উপরোক্ত ক্যাটাগরির প্রতিটি থেকে এক একজনকে বোর্ডে মনোনীত করার ক্ষমতা দেয়।   এদের মুসলমান হতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।   বরং এই বিল অনুযায়ী বোর্ডে দুজন অমুসলিম সদস্য এবং  শিয়া, সুন্নি ও মুসলমানদের অনগ্রসর শ্রেণীর প্রতিটি থেকে কমপক্ষে একজন করে সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক। রাজ্যে যদি বোহরা এবং আগাখানি সম্প্রদায়ের ওয়াকফ সম্পত্তি থাকে তাহলে বোহরা এবং আগাখানি সম্প্রদায়ের একজন করে সদস্য ওয়াকফ বোর্ডে থাকতেই হবে।   বর্তমান আইনে বলা হয়েছে বোর্ডে  কমপক্ষে দুইজন মহিলা সদস্য রাখতে হবে। প্রস্তাবিত  বিলে বলা হয়েছে, বোর্ডে দুইজন মহিলা মুসলিম সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক।

ট্রাইব্যুনালের গঠন: বর্তমান আইনে ওয়াকফ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য রাজ্যগুলিকে ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হয়।   এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে অবশ্যই ক্লাস-১, জেলা, দায়রা বা সিভিল জজের সমতুল্য পদমর্যাদার বিচারক হতে হবে।   অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে  একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমান একজন অফিসার এবং মুসলিম আইন ও আইনশাস্ত্রে জ্ঞানী একজন ব্যক্তি। প্রস্তাবিত   বিল অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল থেকে ‘মুসলিম আইন ও আইনশাস্ত্রে জ্ঞানী ব্যক্তি’কে বাদ দিয়ে   এর পরিবর্তে সদস্য হিসাবে একজন বর্তমান বা প্রাক্তন জেলা আদালতের বিচারককে ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান এবং রাজ্য সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন বর্তমান বা প্রাক্তন অফিসারকে নিয়োগ করতে হবে৷ 

ট্রাইব্যুনালের আদেশের উপর আপীল: বর্তমান আইন অনুসারে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং আদালতে এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল নিষিদ্ধ। প্রস্তাবিত   বিলটি ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করার বিধানকে খারিজ করেছে এবং   ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: বিলটি কেন্দ্রীয় সরকারকে ওয়াকফের রেজিস্ট্রেশন, হিসাব নিকাশ এবং ওয়াকফ বোর্ডের প্রোসিডিংসকে পাবলিক ডোমেনে প্রকাশিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রুল তৈরি করার ক্ষমতা দিয়েছে। বর্তমান আইন অনুসারে রাজ্য সরকার যেকোনো সময়ে ওয়াকফের হিসাব পরীক্ষা করতে পারে।   প্রস্তাবিত বিলটি কেন্দ্রীয় সরকারকে সিএজি বা একজন মনোনীত অফিসারের দ্বারা এইগুলি পরীক্ষা করার ক্ষমতা প্রদান করেছে। 

বোহরা এবং আগাখানির জন্য ওয়াকফ বোর্ড: বর্তমান আইনটি শুধুমাত্র সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফ বোর্ড স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে যেখানে প্রস্তাবিত   বিলটি পিছিয়ে পড়া আগাখানি এবং বোহরা সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফ বোর্ডের অনুমতি দিয়েছে।

কেন্দ্রের আনা এই বিলকে সমর্থন করে আমাদের প্রত্যেককে jpcwaqf-iss@sansad.nic.in ইমেল আইডি-তে সমর্থন সূচক ইমেল পাঠানো উচিত। এই ইমেলে নিজের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর দিয়ে ‘I support Waqf Amendment Bill 2024’ লিখে সকলকে ইমেল করতে অনুরোধ করছি।

ধন্যবাদ

17 Comments

  1. যেখানে দেশের মূল ধারা হিন্দুত্ব এবং ভারতের সর্ব শির্ষে একজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের কার্যকর্তা হাল ধরেছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি, সে দেশে এই সব ব্যাভিচার কেন হবে?

  2. The mussalman WAQF repeal bill 2024.
    🙏🚩
    I strongly support this anti muslim Bill.

    অনেক নতুন তথ্য পেলাম। 🙏🚩

  3. I do sincerely & wholeheartedly Support the Waqf Amendment Bill, 2024 as the Same is towards the Secularism Culture of this Great Country, our Motherland

  4. I strongly support the Wakf repeal Amendment as soon as possible..and hope that, Modiji led NDA Government will rectify the mistakes ,those past Governments has done..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *