কেন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি?

কেন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি? একটা গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তির দাবিই কি যথেষ্ট নয়? মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি কেন? অবশ্যই যুক্তির কথা। তবে প্রশ্ন হল অপরাধী কে? অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব কার? আরজি করের ঘটনায় তার ভুমিকা কি? প্রশ্ন হল পশ্চিমবঙ্গে লাগাতার নারী নির্যাতনের স্থায়ী সমাধান কি? পশ্চিমবঙ্গে লাগাতার নারী নির্যাতনের ঘটনায় ইতি টানার দায়িত্বই বা কার? এই কাজে তার অবস্থান কি আদৌ ইতিবাচক? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিচার চায়। সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই অপশাসন থেকে পরিত্রাণও চায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই নৈরাজ্যের অবসানও চায়, আগামী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতও চায়। তাই অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে খুঁজে নিতে হবে নিরপেক্ষ অবস্থানে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে।

আপনারাই ভাবুন আরজি করের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভুমিকা কী ছিল? তারা কি অপরাধীকে ধরতে তৎপর হয়েছিল? না কি তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে ব্যস্ত ছিল? এফ আই আর দায়ের করতে এত দেরি হল কেন? ঘটনাস্থলে নির্মাণকাজের নামে ভাঙাভাঙি করার সুযোগ দেওয়া হল কেন? হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি ফোন করে নির্যাতিতার পরিবারকে কেন জানানো হল যে অভয়া আত্মহত্যা করেছে? এই রকমের একটা সংবেদনশীল ঘটনায় পোস্ট মর্টেম করার পরে তড়িঘড়ি শবদেহ চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? আরজি কর হাসপাতালে অবস্থানরত প্রতিবাদী ডাক্তারদের উপরে হামলা করার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে দুষ্কৃতিদের সংগঠিত করার পিছনে কারা ছিল? ডাক্তারদের আন্দোলন ভেস্তে দেওয়াই যদি এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল, তাহলে এই দুষ্কৃতিরা হাসপাতালের তিনতলায় ভাঙচুর করতে কেন গিয়েছিল? গুণ্ডাবাহিনী যখন হাসপাতালে দৌরাত্ম করছিল তখন পুলিশের ক্ষাত্রতেজ কোথায় ছিল যা ছাত্রদের নবান্ন অভিযানের সময়ে দেখা গেল? সিবিআই কেসটা হাতে নেওয়ার আগেই সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে হবে- এটাই কি আসল উদ্দেশ্য ছিল? না হলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে- এটাই কি সব থেকে বড় ভয় ছিল? তাই পুলিশ এই দুষ্কৃতিদের বাধা দিল না? এখন প্রশ্ন হল এই যে পুলিশ মন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়াই কি পুলিশ এই ন্যক্কারজনক ভুমিকা পালন করছিল? যে সরকারে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট, সেই সরকারের কার কাছ থেকে কলকাতা পুলিশের কর্তারা আদেশ নেয়? পুলিশ মন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া পুলিশের একটা হাঁচি দেওয়ারও ক্ষমতা আছে? পুলিশ মন্ত্রী কি পুলিশের এই অপকর্মের দায় এড়াতে পারেন? এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর আপনারা সহজেই খুঁজে পাবেন যদি পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির প্রভাব মুক্ত হয়ে, বিবেককে জাগ্রত রেখে উত্তর খুঁজতে শুরু করেন।

এবার প্রশ্ন হল এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুমিকা কী ছিল? ঘটনাস্থলে নির্মাণকাজের নামে ভাঙচুর করার অনুমতি কে দিয়েছিল? আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ থাকা সত্বেও উনি অধ্যক্ষ পদে কিভাবে টিকে ছিলেন? ঘটনার পরে চাপে পড়ে আরজি করের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণের পর তাকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের মাথায় এবং শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ওএসডি করা হল কেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এত অনুগ্রহ কেন এই অভিযুক্তের প্রতি? পক্ষান্তরে আমরা দেখলাম বিচার চেয়ে যে ডাক্তাররা আন্দোলন করছিলেন তাদের অনেককেই পানিশমেন্ট পোস্টিং দিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। কেন? কেন? কেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই এই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কারও আছে? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার কুশীলবদের প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠলে তা কি মিথ্যা বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

পশ্চিমবঙ্গে যে সরকার চলছে তার মাথায় আছেন মমতা ব্যানার্জী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনিই পুলিশ মন্ত্রী, তিনিই স্বাস্থ্যমন্ত্রী! এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অভিযুক্তদের উপরে তিনি বরদ হস্ত, আর যারা বিচার চাইছে তাদের উপরে খড়গ হস্ত! কেন? উনি কি চাইছেন না যে নির্যাতিতা বিচার পাক? অপরাধীদের কঠোর সাজা হোক? তাঁর চোখে অবশ্য এসব ছোট ঘটনা! শরীর থাকলে যেমন জ্বরজ্বালা হয়, সেরকমই মাঝে মাঝে ধর্ষণ হয়েই থাকে! পার্ক স্ট্রিট হোক বা হাঁসখালি, উনি তদন্ত ছাড়াই বলে দিতে পারেন, ধর্ষণের কারণ ‘রেট নিয়ে ঝামেলা’ অথবা প্রেম ঘটিত ব্যাপার! উনি আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা বলার পরে অনেকে বলছে পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণের রেট আপাতত যে বেঁধে দেওয়া হল এটাই কি পশ্চিমবঙ্গের মহিলাদের প্রতি সুবিচার নয়! যাই হোক মুখে নির্যাতিতার ফাঁসী চাই, ধর্ষিতার ফাঁসী চাই বললেও উনি কিন্তু সপার্ষদ রাস্তায় নেমেছেন! নিজের ঘাড় থেকে সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সিবিআই-য়ের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছেন।

নারী নির্যাতনের সুরাহা চেয়ে উনি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লম্বা চিঠি লিখেছেন। কেন্দ্র থেকে সেই চিঠির উত্তরও এসেছে। সেই চিঠিতে কেন্দ্র সরকার জানিয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতাতে নারী সুরক্ষার জন্য কি ধরণের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্র একটা পরিসংখ্যান দিয়েছে যেটা মমতা ব্যানার্জীর এই ভণ্ডামিকে ফাঁস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেন্দ্র জানিয়েছে, নির্যাতিতাদের তাড়াতাড়ি সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ১০৩ টি ধর্ষণ এবং পকসো সংযুক্ত ফাস্ট ট্র্যাক স্পেশাল কোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ এর জুন মাস পর্যন্ত এগুলির একটিও কার্যকর করতে পারে নি রাজ্য সরকার। এছাড়াও ২০২৩ এর জুন মাসে আমাদের রাজ্যের জন্য কেন্দ্র থেকে আরও ১৭ টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের অনুমোদন দেওয়া হলেও মাত্র ৬ টি কোর্টই কার্যকর করতে পেরেছে রাজ্য সরকার। বর্তমানে ৪৮৬০০ টি রেপ এবং পকসো কেস ঝুলে থাকলেও তাড়াতাড়ি বিচার শেষ করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার বাকি ১১ টি কোর্ট শুরু করার জন্য কোনও পদক্ষেপই নেয় নি।

এই তথ্য এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ভুমিকা প্রমাণ করছে না যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নারী সুরক্ষার প্রতি শুধুমাত্র উদাসীনই নন, বরং অপরাধীদের, ধর্ষকদের, নারী নির্যাতনকারীদের নিরাপত্তা দিতেই বেশি উদ্যোগী? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আরজি করের ঘটনার দায় কোনও ভাবেই কি এড়াতে পারেন? সরকারের মন্ত্রী জেলবন্দী, শাসকদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা জেলবন্দী, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের অনেকের দিকে দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ আকাশে বাতাসে! সব মিলিয়ে এই সরকার এবং তার মাথা মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে শুধুমাত্র সঞ্জয়কে ধনঞ্জয় বানিয়ে ফেললেই এই সমস্যার সমাধান হবে না, অভয়া সঠিক বিচার পাবে না। এই রাজ্য এবং রাজ্যের মানুষকে মানুষের মত বাঁচতে হলে এই সরকারকে বিসর্জন দিতে হবে। তাই দল-মত নির্বিশেষে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এই সরকারের রাজ্যবাসীকে নিরাপত্তা দেওয়ার, দুষ্কৃতিদের শাস্তি দেওয়ার, অত্যাচারিতদের সুবিচার দেওয়ার এবং রাজ্যকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা এবং সদিচ্ছা- কোনোটাই নেই। তাই দিকেদিকে একটাই স্লোগান উঠছে- দাবী এক, দফা এক; মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই জনরোষের ঘটনা বিরল।

তাই যদি প্রকৃত অর্থে এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে মমতা সরকারকে গঙ্গাজলে বিসর্জন দিতেই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *